একজন আহমদ ছফা
একজন বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিতবুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
আহমদ ছফা তাঁর বিখ্যাত “বাঙালি মুসলমানের মন” (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) প্রবন্ধসংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনিকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন।
আহমদ ছফা ও তাঁর রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত।
জীবিতকালে আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
শিক্ষা ও জীবন,
শামসুল আরেফীন রচিত আহমদ ছফার অন্দরমহল গ্রন্থে প্রকাশিত ১৯৫৬ সালে দশম শ্রেণিতে থাকাকালে আহমদ ছফার প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষার ইংরেজি ২য় পত্রের রেজাল্ট শিট আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’ ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন।
পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।
সাহিত্যকর্ম,
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় লেখা হলো আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা “যদ্যপি আমার গুরু”।
মননশীল সাহিত্য,
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ। প্রকাশকাল- শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ। ১৯৭২-এ প্রকাশ পায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস এবং ১৯৮১-এ বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থ প্রকাশ পায়।
বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রেণি। এরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করে। কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মান শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে। অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগান্ডা করিয়ে দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে। চিন্তাশূন্যতা এবং কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হল ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।
—বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২)
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা প্রকাশ করেন। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী’এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন।সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে। আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। ছফার ভাষায়:
“ আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে। ”
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ—এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন। ছফা বলেন, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাঁদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না।তাই ছফা বলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।
“ আমি জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের অপূর্ণতা, অক্ষমতা এবং অসহায়তার দিকটাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বাঙালি মুসলমানরা এ দেশের মাটির আসল সন্তান। তারা প্রভুত্বকামী আর্যদের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত নয়, তেমনি আগ্রাসী তুর্কি, তাতার, ইরানী, তুরানীদেরও কেউ নয়। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান একটা নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী। ”
—আহমদ ছফা, ১৯৯৪[৫১]
বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে। গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মাসিক সমকালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত প্রবন্ধ “বাঙালি মুসলমানের মন।” “বাঙালি মুসলমানের মন” প্রবন্ধে ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন। ছফার মতে, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিতম উৎস। তাঁর মতে, বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতার শিকড়ও বর্ণাশ্রম প্রথাতে প্রোথিত আছে। আর শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতির কারণে বাঙালি মুসলমান আজ পর্যন্ত তাদের জাতিগত হীনম্মন্যতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে নি। আর তাই ‘বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে।’ প্রবন্ধটির পটভূমি ব্যাখ্যা করে সলিমুল্লাহ খান মন্তব্য করেছেন, বাঙালি মুসলমান আসলে কোনও জাতিগোষ্ঠী নয়। এটি একটি বিশেষ শ্রেণির নাম, যারা মুসলমান ও বাংলায় কথা বলেন এবং এ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। ‘বাঙালি ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর শোষিত শ্রেণির একটি বিশেষ অংশ, যাদের হীনম্মন্যতার অবসান হয়নি, তারাই এই বাঙালি মুসলমান। সময় বদলালেও এই হীনম্মন্যতার সংকটের অবসান হয়নি। এর কারণেই সব স্তরে বাংলা ভাষার দুরাবস্থা এখনও কাটেনি।
১৯৯২ সালে রচিত “বাংলাদেশের উঁচুবিত্ত শ্রেণি এবং সমাজবিপ্লব প্রসঙ্গ” প্রবন্ধে ছফা বলেছেন, দরিদ্র ও সংগ্রামরত বিশাল আম জনতার সাথে দেশের শহুরে সুশীল সমাজ ও শাসক শ্রেণির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের অভিজাতরা বিদেশিদের চেয়ে বেশি বিদেশি সেজে থাকে। তারা কাল্পনিক বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা বোধ করে, যার কোনো শিকড় বাংলাদেশের কোটি জনতার রূঢ় বাস্তবতায় নেই। ছফা আরো বলেন, বাঙালি সাধারণ মুসলমানরা আদৌ গোঁড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল না, কিন্তু শাসকশ্রেণির সাথে তাদের সতত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দূরত্ব ও নিরবচ্ছিন্ন শোষণ ও আর্থরাজনৈতিক বঞ্চনা তাদের মাঝে ক্রোধ ও ক্ষোভে পূর্ণ পলকা অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যে অবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলো বাংলাদেশে জনমত গঠন করতে পারছে।
কথাসাহিত্য,
সলিমুল্লাহ খান ও আরো অনেকের মতে, আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতে, ছফা গল্প বলার কলা অল্পবয়সেই রপ্ত করেছিলেন।তাই পাঠকরা তার ডাকে সাড়া দেয়।
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭) আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ। উপন্যাসটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যান বলা হয়েছে যদিও বরুমতির আঁকেবাঁকে নামক একটি গ্রন্থও তাঁর প্রথম গ্রন্থের দাবিদার।
ওঙ্কার (১৯৭৫) ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত ওঙ্কারে একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে ধারণ করেছেন লেখক। ওঙ্কারে বোবা বউয়ের ‘বাঙলা’ উচ্চারণের সমান্তরালে “জাতিসত্তার জাগরণের অন্তর্সত্য বিধৃত হয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন, ওঙ্কারে “ছফার কোনো চরিত্রই শুধু একটি ব্যক্তি নয়, বহু কালের বহু মানুষের বহন করার শক্তি দিয়েই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন।”ইলিয়াস আরো বলেন, একটি জনগোষ্ঠী থেকে পরিপূর্ণ একটি জাতিতে পরিণত হওয়ার সংকল্প ঘোষিত হয়েছে ওঙ্কারে।
একজন আলী কেনানের উত্থান-পতনে (১৯৮৮) ছফা বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে আলী কেনান নামের মূল চরিত্রের উত্থান ও পতন উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু শেখ মুজিবের শাসনামল পর্যন্ত রাজনীতির উত্থান পতন আলী কেনানের উত্থান পতনের সমান্তরালে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সলিমুল্লাহ খান আলী কেনানকে শেখ মুজিবুর রহমানের রূপক মনে করেন।
মরণবিলাসে (১৯৮৯) চিত্রায়িত হয়েছে মৃত্যুশয্যায় এক মন্ত্রী যে তার রাজনৈতিক অনুসারী মাওলা বক্সের কাছে তার সারা জীবনে কৃত অপকর্মের বর্ণনা দেয়।মন্ত্রীর অপকর্মগুলো খুন, ব্যভিচার, ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘিরে আবর্তিত হয়।
অলাতচক্র (১৯৯৩) প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি, তার নানা পর্যায়, সবলতা ও দুর্বলতাগুলোসহ কোটি নিরাশ্রয় মানুষের আকুতি, বেদনা ও স্বজন হারানোর শোক শাশ্বতরূপ পেয়েছে উপন্যাসটিতে। সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, প্রেমাবেগ এবং দ্বন্দ্বের বিষয়টিও লেখক শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির গোপন-রহস্য, শৌর্য মৃত্যু ও কপটতার তথা ব্যক্তিগত প্রেমের গীতিকা এই উপন্যাস। যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো সবাই রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মানুষ।
গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) উপন্যাসের মূল কেন্দ্র একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা লোক বিশ্ববিদ্যালয়, উপন্যাসের ভাষায়, ‘দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মূল চরিত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত উপাচার্য মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আবু জুনায়েদের আরোহণ এবং এর আগে ও পরে শিক্ষক রাজনীতিকে ঘিরে ঘটনাচক্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু।
পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ।[৬৫] পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার এই উপন্যাসে।
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) উপন্যাসটি ছফার ব্যক্তিগত প্রেমকে উপজীব্য করে রচিত। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ছফাঅর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীকে তাঁর প্রেমের সৌধ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।
পুরস্কার,
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাকে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
প্রবন্ধ,
জাগ্রত বাংলাদেশ (১৯৭১) বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে (১৯৭৫) বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা (১৯৭৭) বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৯) রাজনীতির লেখা (১৯৯৩) আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ (১৯৯৪) নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ (১৯৯৫)সঙ্কটের নানা চেহারা (১৯৯৬) সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৯৭) শতবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৭) শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৯৮) বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র (২০০১) উপলক্ষের লেখা (২০০১) আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০২) সেইসব লেখা (২০০৮) সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস (১৯৭৯)
উপন্যাস,
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭) ওঙ্কার (১৯৭৫) একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮) মরণবিলাস (১৯৮৯) অলাতচক্র (১৯৯৩) গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (আত্মজৈবনিক প্রেমের উপন্যাস,১৯৯৬) পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬) যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)
অনুুবাদ,
তানিয়া (মূল: পি. লিডভ) (১৯৬৭) সংশয়ী রচনা: বার্টাণ্ড রাসেল (১৯৮২) ফাউস্ট (মূল: ইয়োহান ভোলফ্ গাঙ ফন গ্যোতে) (১৯৮৬)
কবিতা,
জল্লাদ সময় (১৯৭৫) দুঃখের দিনের দোহা (১৯৭৫) একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭) লেনিন ঘুমোবে এবার (১৯৯৯) আহিতাগ্নি(২০০১)নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯) ইত্যাদি।